Short Stories

একজন বণিক আত্মহত্যা করেছিলো পরবর্তী জীবনের লোভে ॥ মেহেদী শামীম

By Mehedi Shamim | 16 Jan, 2022

একজন বণিক আত্মহত্যা করেছিলো পরবর্তী জীবনের লোভে ॥ মেহেদী শামীম

ঘরটাতে কোন সিগারেটের গন্ধ নেই। যদিও এখানে ক্রিয়েটিভ আইডিয়ার নির্মাণ হয়।কথিত আছে, আইডিয়া নির্মাণ আর সিগারেট অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত থাকে। এই দেশের কথার ভিত্তিও অনেকটা দুর্বল। তাই এই কথাটাকে সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নেই। এই ঘরটার মানুষজন যদিও বিপরীত ¯্রােতের না। তারা ছোট একটা মুখোশ পরে আছে যে, তারা ¯্রােতের বিপরীতে ছুটছে। কিন্তু মূলত তারা একটি আবদ্ধ জলের সিমানার মধ্যে। তারা প্রগতিশীলতাকে তাদের মতো করে ব্যবহার করতে চায়। যেমনটা দেখা যায়, এই ঘরে মেয়েদের ক্ষেত্রে সিগারেট খাওয়ার অধিকার সংরক্ষিত রয়েছে। যদি কোন মেয়ে এসে সিগারেট খায় তাকে কেউ বাঁধা দেয় না।কিন্তু ছেলেদের এই ঘরে সিগারেট খাওয়া দন্ডনীয় অপরাধ।

আলভির দর্শন হলো, খারাপ ছেলেরা সিগারেট খায়। আর ভালো ছেলেরা;নেশা খেলে, শুধু মদ খায় কিন্তু সিগারেট খায় না। আর সে কখনো খারাপ ছেলে হিসেবে মানুষের কাছে পরিচিত হতে চায় না। তাই সিগারেট খেলেও লুকিয়ে-লুকিয়ে খায়।

এই অফিস কাম আড্ডা দেয়ার জায়গাটার প্রধান কর্তা হলো আলভি।এই ঘরের প্রতিটি জানালায় ভারি পর্দা দেয়া। আলু মজুদ রাখা কোল্ডস্টোরেজ ঘরের মতো অনেকটা গুমোট হয়ে আছে।

ঘরে যারা নিয়মত আসে, সিনেমা বানানোই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। এখানে তাদের বলতে বোঝানো হয়েছে একদল তরুন-তরুনী। এই সিনেমা বানানোর ফাঁকে ফাঁকে তারা মানুষের শরীরের মধ্যে কলম দিয়ে অঙ্ক কষতে পছন্দ করে। তাদের বিশ্বাস জগতের সমস্ত কিছুর সমাধান ওই শরীরের মধ্যে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রয়েছে।

 

আজকে তীব্র গরম। শরীর আজকাল তীব্র প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠছে। কোন কিছুই সহ্য করতে চায় না। গরম অথবা শীত কোনটাই মানিয়ে নিতে পারে না। এই প্রাকৃতিক অবস্থাতেও মানুষ অপেক্ষা করে নতুন সম্ভাবনা তৈরির জন্য। আলভি আর তার একজন সহযোগী অপেক্ষা করছে; একটি মেয়ের জন্য। নতুন গল্প নির্মাণ করবে তারা। আলভি বার বার কম্পিউটারে পুরোনো প্রোডাকশনগুলো বের করে দেখছে। আর নিজের কাজের মুগ্ধতায় নিজেই বিচলিত হচ্ছে। একটু পর-পর তাকে কোন অদৃশ্য লোক সুরসুরি দিচ্ছে, সে পুলকিত হয়ে নড়ে-চড়ে বসছে।

তখনই কলিংবেল বেজে উঠলো।

অপ্রত্যাশিতভাবে মেয়েটির সাথে আরেকটি ছেলে চলে আসছে। তাতে অবশ্য আলভির কিছু যায় আসে না। কারণ তার হাতে আছে যাদুর চেরাগ। দেশলায়তে ঘষা দিলেই জ্বলে ওঠে আগুন। এই সব ঘটনা অনেকবার সে ম্যানেজ করেছে। যখন-তখন এই সব ছেলেদের সাথে মেয়েরা সম্পর্ক চুকিয়ে নেয়। তাই তার মধ্যে কোন বিরক্তিমূলক আচরণও দেখা গেলো না। কিন্তু এই ঘর কিছুটা বিরক্ত। আরেকটি অতিরিক্ত মানুষের শরীরিক তাপ নিতে পারছে না ঘরটা।অবশ্য এই ঘরের অনুভূতির দিকে কেউ একবার ফিরেও তাকায় না।

হুড়মুড় করে তাদের পরিচয় পর্ব শেষ। কারণ এই পর্বে খুব একটা সময় অপচয় করে না আলভি। এইবার অডিশনের পালা:

রুকাইয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ বর্ষে পড়াশুনা করছে। তার শরীরে যেখানে যতটুকু মাংস থাকা দরকার পরিমান মতোই আছে। চুলগুলো বার বার এদিক-সেদিক উড়ে উড়ে ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে। জামা-কাপড় পরেছে এইটুকু দেখাবো, ওইটুকু দেখাবো না টাইপ। অনেক চটপটে মেয়ে। বাবা-মা ছাড়া বন্ধুবির সাথে ছোট একটা বাসা নিয়ে থাকে। মিডিয়াতে টুকটাক কাজ করেছে। আরো কাজ করতে চায়।

তাদের আলোচনা শুরু হয়ে গেলো:

আলভি: রুকাইয়া অন-স্ক্রীনে তোমাকে একটি সাহসী রোল প্লে করতে হবে।

রুকাইয়া: হুম আমি তো অনেক সাহসী। অন্য মেয়ের মতো তেলাপোকা-টিকটিকি ভয় পাই না।আমার কাছে দুঃসাহসিক কাজ করতে খুব ভালো লাগে

আলভি: বেপারটা ঠিক ওইরকম না। ধরো...

রুকাইয়া: ওহ আমাকে দিয়ে কি এ্যাকশন টাইপ কোন অভিনয় করাবেন। আমি কিন্তু ফাইট করতে পারি।

আলভি: না এ্যাকশন না। ধরো বাথটাবে (খানিকটা অস্পষ্ট)

রুকাইয়া: কি বললেন বুঝলাম না.. আমার সমস্যা নাই তো আমি আত্মবিশ্বাসি। যেকোন কঠিন দৃশ্য করতে পারবো। আমি আসলে অভিনয়টাকে প্রফেশন বানাতে চাই।

আলভি: তোমাকে একটুবোল্ড হতে হবে। কারণ চরিত্রটি..

রুকাইয়া: আমি অনেক স্ট্রং মেন্টালিটির.. আমি পারবো.. আপনি ভরসা রাখুন ওই যে নতুন একটা গান ভাইরাল হয়েছে না। সনু তুমি আমাকে ভরসা করো না (?) (!)

আমি কিন্তু সনুর মতো না। আমার উপরে ভরসা রাখতে পারেন। অবশ্য ওই গানটা দিয়ে আমিও একটা ভিডিও বানিয়েছি। ফেসবুকে ‘সেভেন কে’ ভিউজ।

আলভি: আরে বাবা আমাকে তো বলতে দিবা...

রুকাইয়া: আচ্ছা বলেন।

আলভি: একটা অন্ধকার রুমে..

রুকাইয়া: বুঝতে পারছি এটা ভুতের সিনেমা।

সমস্যা নাই আমার অন্ধকারে ভয় নাই। আমি পারবো আমাকে গল্পটা দেন একটু পড়ি।

আলভি: আসলে আমার গল্পটা এখনো লেখা শেষ হয়নি; আমার মাথায় আছে। তোমাকে দেখেই আমার মধ্যে আরো গল্প জমাট বাঁধছে।

রুকাইয়া: তাহলে মাথা থেকেই বলেন। আমার মনে থাকবে.. আমার আবার মেমোরিজ অনেক ভালো।

আলভি: আচ্ছা শোন, তোমাকে একটা কাজ দেই ওইটা আগে করো... আজকে রাতে ক্লাসিকাল মিউজিক ফেস্টিভাল হচ্ছে.. সেখানে গিয়ে সারারাত উচ্চাঙ্গ সংগীত শোন। কারণ তোমাকে সবার আগে ভালো শ্রোতা হতে হবে।

পাশে বসে থাকা ছেলে বন্ধু মাথা নিচু করে বসে আছে। তার পরিচয় এই গল্পে অতটা জরুরি নয়। কারণ এই অবস্থায় জগতের সব ছেলে বন্ধুদের ভূমিকা এবং অনুভূতি প্রায় সমান। তারা নিজেদেরকে পৃথীবিতে অপ্রয়োজনীয় ভাবতে শুরু করে। রাতের বেলারসানগ্লাসের মতো। তাদের নিয়ে তেমন আলোচনার জায়গা তৈরি হয় না এই সব ফোরামে।

কিছুটা সময়ের জন্য রুকাইয়া এবং তার ছেলে বন্ধু এক সাথে কথা বলার সুযোগ পেয়েছে। কারণ সবাই ঘর ছেড়ে সিগারেট খেতে বাইওে গেছে।

রুকাইয়াকে একলা ঘরে পেয়ে তার ছেলে বন্ধু বোঝাতে চেষ্টা করেছে তুমি ভুল জায়গাতে আসছো। কিন্তু সেই সুযোগ ছেলেটা পায়নি।

কারণ মেয়েটি আবার কথা বলা শুরু করেছে:

‘বেবি শোন, দেখো আমার ডিরেক্টর কত ভালো। তুমি কি সব উল্টা-পাল্টা বলতেছিলা। আসতে চাইতে ছিলা না। দেখছো কতটা সংস্কৃতিমনা মানুষ। আমাকে সে ক্লাসিকাল মিউজিক ফেস্টিভালে গান শোনার জন্য যেতে বলছে। তোমার কাছে তো, তুমি ছাড়া সমস্ত‘পুরুষ সমাজ’ খারাপ। চরিত্রহীন। দেখছো সে আমাকে অলরেডি এ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে দিলো। কাজের প্রতি সে কতটা সিরিয়াস।’

ছেলেটির সরল প্রশ্ন: কেন?

মেয়েটি বললো, ‘বুঝো না তুমি। বোকা ছেলে। গল্পের চরিত্রটা ভালো করে বোঝার জন্য। নিশ্চয়ই উচ্চাঙ্গসংগীত রয়েছে সিনেমার গল্পে। আমি কিন্তু আজকেই যাবো। তোমাকেও যেতে হবে।’

ছেলের মনের মধ্যে আরো একটি প্রশ্নের জন্ম হলো:

‘আচ্ছা তোমার চরিত্রটা কি হবে এই স্বল্প দৈর্ঘ্য সিনেমাতে?’

এই কথার উত্তর দেয়ার আগে আগে-ই আলভিসহ তার সহযোগীপ্রবেশ করলো।

আলভি এসেই বলতে শুরু করলো, ‘তো কি চিন্তা করলে। গল্পটা নিয়ে।’

রুকাইয়া আকাশ থেকে পড়লো। কই আপনি তো কোন গল্প দেন নি। আমি কি চিন্তা করবো।

ওওহ তাই তো। আচ্ছা আমি মুখে মুখে বলছি।

রুকাইয়া: গল্প সবটা বলতে হবে না। শুধু আমার চরিত্রটা বলেন। কি চরিত্র হবে আমার।

আলভি: দেখো অন্য একটা চরিত্রে যাওয়া অতটা সহজ না। অনেক ধরণের কসরত করতে হবে তোমাকে।

রুকাইয়া: সমস্যা নাই আমি তো সব করবো, আপনার কথা মতোউচ্চাঙ্গ সংগীতও শুনতে যাবো। আমার চরিত্রে’র বর্ণনাটা একটু দেন।

আলভি: দেখো রুকাইয়া বেপারটা এতো সহজ না। অন্য একটা চরিত্রে প্রবেশ করতে হলে  তোমাকে সবার আগে নিজের চরিত্র থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। উদার হতে হবে।

রুকাইয়া: কিভাবে ?

আলভি: প্রথমে তোমাকে চরিত্রহীন হতে হবে তারপরে তো তোমাকে আমি সিনেমায় চরিত্র দিতে পারবো। তার আগে কিভাবে সম্ভব। তোমাকে তোমার খোলস থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে।

রুকাইয়া: আমি চরিত্রহীন হবো?

পাশ থেকে রুকাইয়ার ছেলে বন্ধু উঠে দাঁড়ালো। এবং দরজা দিয়ে বেড়িয়ে গেলো। তার পিছনে পিছনে রুকাইয়া দৌঁড়াতে থাকলো। আর একটুউঁচু আওয়াজে বার বার একটা বাক্য বলতে থাকলো: ‘দেখো এখানে চরিত্রহীন বলতে লম্পট বোঝানো হয়নি। বুঝতে চেষ্টা করো...

আচ্ছা তুমি কোথায় যাচ্ছো? বলে যাও’

‘এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে সবচেয়ে সুন্দর করুণ: সেখানে সবুজ ডাঙা ভরে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল; সেখানে গাছের নাম: কাঁঠাল, অশ্বত্থ, বট, জারুল, হিজল; সেখানে ভোরের মেঘের নাটার রঙের মতো জাগিয়েছ অরুণ; সেখানে বারুণী থাকে গঙ্গাসাগরের বুকে, -সেখানে বরুণ কর্ণফুলী ধলেশ্বরী পদ্মা’...

রুকাইয়া: কি বলো এইসব আগা মাথা কিছু বুঝি না। দূরো, থামাও তোমার আজাইরা আলাপ।

একবারও পিছনে তাকায়নি ছেলেটি। হেঁটে যাচ্ছিলোজলের ¯্রােতের মতো গতিতে। অনেক দূর পর্যন্ত দেখা গেলো নীল শার্ট কালো প্যান্ট পরা বোকা ছেলেটাকে।

তখন আলভিরা ঘরের মধ্যে কি করছিলো অনুমান করা সম্ভব না। তারা সাথে সাথে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলো। কারণ ঢাকা শহরে দরজা খুলে রেখে দিতে নেই।

 

রুকাইয়ার স্বল্প দৈর্ঘ্য সিনেমা বের হলো। আলোচনার ঢেউ উঠলো। বিভিন্ন ফেসবুক পেইজ-এ ছোট ছোট ক্লিপ বের হলো রুকাইয়ার। এবং সোস্যাল মিডিয়াতে তার সিনেমা ছড়িয়ে পড়লো। গুজব তো স্বভাবতই উঠলো অনেক কিছু। কি কি শেয়ার করতে হয়েছে এই সিনেমা করতে গিয়ে রুকাইয়ার অথবা অন্য কোন রহস্য। কিন্তু সেই গুজব বেশি দিন টিকে থাকলো না। ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলো।

 

রুকাইয়ার জীবন বদলে গেলো। ‘যে জীবন ফড়িংয়ের দোয়েলের- মানুষের সাথে হয় নাকো দেখা’।

রুকাইয়ার ছেলে বন্ধুটির নাম জিদান। গত ছয় বছরে তার একমাত্র অর্জন ছিলো রুকাইয়া। তার কাছ থেকে হয়তো অপসংস্কৃতি অথবা অন্যকোন কারণেকেড়ে নিলো সেই হৃষ্টে-পুষ্টে নির্মাণ করা প্রেম। এখন আর রুকাইয়া জিদানের জন্য নেই। তারবিবিএ পরীক্ষা শেষ এমবিতে ভর্তি হবে হবে ভাব। রুকাইয়ার সাথে যোগযোগ বন্ধ।

শিল্প-সাহিত্যের প্রতি তার ঘৃণা জমতে শুরু করলো। যতটা সুন্দর প্রকৃতি কবিতায় ততটা সুন্দর পৃথিবী না।একবার ঘৃণা জমেছিলো তার এলাকার প্রতি। এলাকার মাস্তান জোড় করে দখল করেছিলো তাদের দুইটা দোকান। কেউ এগিয়ে আসেনি তখন। যদিও এই ঘটনায় তাদের পরিবার তেমন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। কিন্তু তার মনে মনে একটা হট্টগোল লেগেছিলো। জিদান অনেক কিছু মেনে নিতে পারে না। সহ্য করতে পারে না অনেক কিছুই। অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে দেয়।

 

জিদান মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। বাবা-মা ধর্মীয় মূল্যবোধকে পুঁজি করে কাটিয়ে দিচ্ছে তাদের জীবন। জিদানের সাথে তার বাবার সম্পর্ক অনেকটা অস্পষ্ট। জিদানের বাবা যদি কোন কিছু জিদানকে বলতে চাইতো তার আম্মুর মাধ্যমে বলতো। সরাসরি তেমন কোন কথা-বার্তা তাদের মধ্যে তেমন হতো না। তাদের দুজনের যোগাযোগ স্থাপনের একমাত্র মাধ্যম ছিলো জিদানের মা।

আর তাই বাবা-ছেলে ওইভাবে পরস্পর পরস্পরকে চিনে উঠতে পারেনি। একজন দূরত্ব তৈরি করে সম্মান বাড়াতে ব্যস্ত, অন্যজন একটা ভীতির মধ্যে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার অদৃশ্য জীবন।

 

তেমন কোন বন্ধু নেই জিদানের। দিনের অনেকটা সময়েই কাটিয়ে দিতো রুকাইয়ার সাথে। বাকিটা সময়ে নিউজ পেপার আর কবিতাপড়ে কাটিয়ে দিতো। জিদানকে প্রতিদিন বিভিন্ন ধরণের অন্যায়-অবিচারমূলক নিউজগুলো আবেগায়িত করে তুলতো।জিদান স্বপ্ন দেখতো, একদিন সে সামাজিক ব্যবসা করবে। যেই ব্যবসায় সমাজের উপকার হবে এবং সেও সফল হবে জীবনে। দেশের মানুষের জন্য সে অনেক ভাবতো। এবং বিভিন্ন ধরণের ব্যবসার পরিকল্পনা করতো। কিভাবে দেশকে অর্থনীতিতে শক্তিশালি করা যায়। অথবা কিভাবে দেশের নানান রকমের সমস্যা সমাধান করা যায়। এই সব চিন্তার প্রেসার এবং রুকাইয়া কে হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণায় জিদান ভীষণ একা হয়ে গেলো।

জিদানের প্রিয় কবি জীবনান্দ দাশ। প্রিয় গাছ হিজল। সে কবিতার ভিতর দিয়ে ঘুরে বেড়াতো। প্রকৃতির ব্যাকুল ডাকে চলে যেতো প্রাকৃতিক নৈসর্গের মধ্যে।

 

একদিন জিদানের সাথে এক অপরিচিত লোকের দেখা হলো। তার সাথে কথা জমে উঠলো জিদানের। কথা শুরু হলো প্রকৃতি নিয়ে। পৃথিবী সৃষ্টি ও তার সমস্ত রহস্য নিয়ে। ওই অপরিচিত লোকটির পরিচয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ না। জিদান তার মধ্যে একই ধরণের দর্শন খুঁজে পেলো। অদ্ভুতভাবে গুছিয়ে কথা বলে সে। তার কথার মধ্যে এক ধরণের শক্তি আছে।সেও দেশের অগ্রগতি নিয়ে ভাবছে। সেও অবিচার-অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে চায়। পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আর সেই শান্তির বার্তাও তার কাছে আাছে। কথার পিঠে কথা বলে বলে কেটে যাচ্ছে সময়।

 

জিদানের কাছে তাকে অনেকটা স্বয়ংসম্পন্ন মনে হয়। সবকিছুর ব্যাখ্যা খুঁজে পায় ওই লোকের কাছ থেকে সাবলীল ভাষায়। এবং তার কাছে আরো খুঁজে পায় মুক্তির সহজ উপায়। যেই প্রশ্নের উত্তর সে কারো কাছে পেতো না, সেই প্রশ্নের উত্তরও আছে ওই লোকের কাছে। তাকে ‘জীবন পিডিয়া’ নামে ডাকে জিদান।

জিদান মুগ্ধ হয়। কারণ জিদানের কাছে কোন ফর্মুলা ছিলো না। কোন পথ ছিলো না। কিভাবে উত্তরণ পাওয়া যায় এইসব সমস্যা থেকে। যা প্রতিদিন তাকে ভাবাতো। জ্বালাতো।

জিদানের দিনরাত সব পাল্টে যায়। রুকাইয়া তার এক ধরণের শত্রুতে পরিণত হয়। পৃথিবীটা তার কাছে শত্রুর ময়দান মনে হয়। সব কিছুই তার কাছে অপ্রসাঙ্গিক মনে হয়। সে শুরু করতে চায় এক নতুন বাণিজ্য।

জিদান বিবিএ’র ছাত্র। খুব ভালোধারণা রয়েছে ব্যবসা সম্পর্কে তার। ওই মানুষটা তাকে মুনাফা এবং মূলধনেরসন্ধান দিতে থাকে। তারপরে সে ব্যবসা পরিকল্পনা শুরু করে দেয়। জিদানের ব্যবসার মুনাফা ‘জান্নাত’ এবং মুলধন হলো ‘মৃত্যু’। এটা নির্ধারণ করে দেয় ওই লোকটি। এইবার ব্যবসার ছকে এই দুইটাকে ফেলে অঙ্ক কষতে থাকে জিদান।

 

এই ব্যবসা বিষয়ক উচ্চতর কর্মশালা করার জন্য একদিন খুব সকালে গৃহত্যাগ করে জিদান। সে ছোট ছোট কয়েকটা চিঠি লিখে যায় তার কাছের মানুষজনের জন্য।

তার প্রিয় ছোট বোনকে লেখা চিঠি:

ভালো থাকিস। আমি মঙ্গলের পথে যাচ্ছি যার ফলাফল শুধু উত্তম। পৃথিবীর সবকিছুই ফাঁদ। পারলে নিজেকে এই ফাঁদের থেকে দূরে রাখিস।

 

তার মা-বাবার জন্য লেখা চিঠি:

তোমরা কোন কিছু পাল্টাতে পারোনি। কারণ তোমাদের কাছে পৃথিবী মূল্যবান। কিন্তু এটা ঠিক নয়। পৃথিবী তুচ্ছ। তোমারা পৃথিবীতে যে বাণিজ্যে লিপ্ত হয়েছো, ওইটা সত্যিকারের বাণিজ্য না। ওটা ক্ষণিকের বিষয়। আমার জন্য দোয়া করো, আমি উত্তমতম বাণিজ্যের উদ্দেশ্য রওনা হলাম। যা চিরস্থায়ী।

রুকাইয়ার জন্য যেই চিঠিটা লেখাছিলো:

তুমি যেই পথে দৌঁড়াচ্ছো ওটা মিথ্যে পথ, অভিশাপের পথ। উত্তম পথে আসো। সময় থাকতে পর্দা করো। নিজর ইজ্জত সংরক্ষণ করো।

 

প্রতিটা চিঠিই প্রত্যেকের কাছে পৌঁছাতে পেরেছিলো জিদান। রুকাইয়ার কাছে ওই দুইটা লাইনকোন অর্থ তৈরি করতে পারেনি। রুকাইয়া তার আপন শক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে যতদূর চোখ যায় ঠিক তত দূরে। কেউ হয়তো তাকে বাঁধা দিতে আসবে না। পারিবারিক গন্ডি থেকে বেড়িয়ে আসা মেয়েটি তার নিজস্ব স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করে যেতে চায়।

 

ছোটবোন ভেঙে পরেছিলো। বাবা-মাকে বারবার বলছিলো কেঁদে কেঁদে, ভাইয়াকে ফেরাতে হবে। চলো আমরা ভাইয়ার খোঁজ করি। ছোটবোনের আবেগ অতটা চোখে পরেনি কারোই।

জিদানের বাবা-মা থানায় গিয়ে একটা ডায়েরী করেছিলো। যত আত্মিয়-স্বজন রয়েছে সবার সাথে যোগাযোগ করেছিলো। একদিন ক্ষান্ত হতে হয়েছিলো তাদের। নিয়ম করে জিদানের ছবি নিয়ে কান্না করা ছাড়া তেমন কোন উপায় ছিলো না তাদের। দিনের পর দিন পার হয়ে যচ্ছিলো জিদানের কোন খবর পাওয়া যাচিছলো না।

জিদান ছোট একটা ব্যাগ নিয়ে বেড়িয়ে গেছে বাড়ি থেকে। জিদানের মা অনেক আগে থেকেই লক্ষ্য করছিলো জিদানের অস্বাভাবিক আচরণ। বলার চেষ্টাও করেছিলো কিন্তু কেউ তাকে পাত্তা দেয়নি তখন। জিদান বাসায় এসে মায়ের সামনে অথবা বোনের সামনে বেশিক্ষণ থাকতো না। মাথা নিচু করে তাকিয়ে থাকতো। তার কাছে সব কিছু অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে শুরু করে। জিদানের কোন খোঁজ নেই। তার বাবা মা ধরেই নিয়েছিলো জিদান আর ফিরবে। ‘এইভাবে ঘর ছেড়ে যাওয়া মানুষ কখনো ঘরে ফিরে না’, এই কথা সারাদিনই জিদানের মা বলতো।

 

একদিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে খবরের কাগজে জিদানের ছবি দেখে নির্বাক হয়ে যায় তার বাবা-মা। জিদানের সাথে রয়েছে আরো ৫জন ছেলে। সবাই গতরাতে নিহত হয়েছে। পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধে। তারা সারারাত জিম্মি করে রেখেছিলো বিদেশী নাগরিকসহ অনেক মানুষ।

জিদানের বোন চিৎকার করে কান্না করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। অসহায় চোখে ঘরের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

এই পরিবারের উপরে পাহাড় ধ্বসে পড়েছে। শোকে বোবা হয়ে যায় জিদানের বাবা-মা।

 

রুকাইয়া তাড়াহুড়া করে ফেসবুক ঘেটে জিদানের সাথে থাকা ফেসবুকে দুই একটা ছবি যা ছিলো সব ডিলিট করে দিয়েছে। কোন চিহ্ন যাতে কোথাও পাওয়া না যায়। কারণ শহরের সবাই জিদানকে নিয়ে গবেষণা শুরু করে দিয়েছে। কিভাবে সাধারণ মানুষ থেকে এমন ভয়ংকর মানুষ হয়ে ওঠে জিদানরা। এটা জানার অধীর আগ্রহ রয়েছে সবার মধ্যেই। মনে মনে বলতেছিলো রুকাইয়া,‘কোনভাবে যদি জানতে পারে এই ছেলে সাথে আমার সম্পর্ক ছিলো। তাহলে তো আমার ক্যারিয়ারের বারোটা বেজে যাবে’।

 

গোটা শহরে তুল-কালাম কান্ড। বিদেশী নাগরিকসহ ২১জন নিহত। দেশের সবচেয়ে বড় জঙ্গি হামলা এটা। পৃথিবীর সবগুলো নিউজ পেপার কভার করেছে এই নিউজটি। জিদান একজন বণিক হিসেবে সফল। মানুষের জীবনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পরেছে। শহরটা নড়ে-চড়ে বসছে। রাস্তা-ঘাট কেমন যেন কাঁপছে। শহরের ব্রিজগুলো দুলছে।থমথমে একটা বাতাস কানের পাশ দিয়ে এদিক ওদিক ছুটে যাচ্ছে। মানুষের ¯্রােত যদিও থামানো কঠিন।

 

একদিন পরপরই যে যার মতো কাজে নেমে গেছে। জীবন তার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। রুকাইয়া প্রতিদিন নিয়ম করে আলভির সেই আড্ডা খানায় যাচ্ছে। তার নতুন প্রেমিক হয়েছে। কিন্তু সমস্যা একটা উদয় হয়েছে রুকাইয়ার জীবনেও। তাকে কেউ একজন ফলো করে। তার পেছন পেছন যায়। সে বাজার করতে গেলে তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকে। সে পার্লারে গেলে নিচে দাঁড়িয়ে থাকে। রুকাইয়ার সন্দেহ জাগে। রাতে ঘুমাতে পারে না সে। সারারাত তারনতুন ছেলে বন্ধুর সাথে ফোনে লাইনে থাকে। তার মনে হয় এই বুঝি দরজায় এসে ছেলেটা কলিংবেল বাজাবে। কিন্তু কেউ আসে না। এই ভয় আরো তীব্রতর হয়ে ওঠে।

 

হঠাৎ রুকাইয়ার মনে হয় ওই ছেলেটা জঙ্গি গ্রুপের কেউ না তো। এই সব চিন্তায় সে ঘরের মধ্য দিয়ে এলো-মেলো করে হাঁটতে থাকে। হঠাৎ জিদানের চিঠিটা চোখে পরে রুকাইয়ার। আবারও একবার পড়ে নেয় চিঠিটা। স্পষ্ট অক্ষরগুলো তার দিকে তীরের মতো ছুটে আসে।

 

রুকাইয়া পরেরদিন দোকানে গিয়ে হিজাব এবং বড় বড় সেলোয়ার কামিজ কিনে নিয়ে আসে। সে পুরোনো জামা কাপড় সব ফেলে দেয়। এখন থেকে সে হিজাব পরে বের হয়। কিন্তু তখন পর্যন্তওওই ছেলে তার পিছু ছাঁড়ে না।

তাকে অনুসরণ করতেই থাকে। আঁঠার মতো লেগে থাকে ছেলেটা। মানুষের জীবনে কখন কোন প্রেম এসে জাপটে ধরে বসে, তা বোঝা খুব মুশকিল।

 

রুকাইয়া কোন কুল কিনারা না পেয়ে তার ছেলে বন্ধুসহ পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে যায়। পুলিশ খুব তৎপর হয়ে ওঠে। পরের দিনই ছেলেটাকে ধরে ফেলে পুলিশ। জিঙ্গাসাবাদের জন্য তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। রুকাইয়া আরো বেশি চিন্তিত হয়ে ওঠে। বাসা থেকে একদম বের হয় না রুকাইয়া।

একদিন থানা থেকে ফোন আসে রুকাইয়ার কাছে। পুলিশ ফোন করে রুকাইয়াকে বলে, ‘দেখেন ছেলেটা আসলে জঙ্গি না। আমরা ভুল সন্দেহ করেছি। মূলত সে আপনাকে পছন্দ করতো। তাই আপনাকে ফলো করতো। আমরা ওকে ঈভ টিজিং মামলায় আদালতে পাঠিয়ে দিবো।’

এই কথা শোনার পরে কিছুক্ষণ দম নেয়। একটু স্বস্থি ফেরে তার জীবনে। রুকাইয়া পুলিশকে বলে দেয়, ‘আপনারা যেটা ভালো মনে করেন। তাই করেন আমার কিছু বলার নেই।’

কিন্তু ফোন রাখার পরে এক ধরণের অনুভূতি তার মাথার মধ্যে চুলকাতে থাকে।

রুকাইয়া থানার ওই পুলিশকে আবার ফোন করে। এবং অনুরোধ করে বলে, ‘ওই ছেলেটাকে কি ছেড়ে দেয়া যায়!

আমার কোন অভিযোগ নেই ছেলেটার উপরে।’

পুলিশ কিছুটা ভড়কে যায়, তারপরে বলে‘কেন আপা আপনি তো কঠোরভাবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন। আমরা একবার ভেবেছিলাম ছেড়ে দিবো। কিন্তু আপনার কথা ভেবে আর ছাড়লাম না।’

 

রুকাইয়া বলে, ‘ওকে ছেড়ে দিয়ে ভালোবাসাকে বেঁচে থাকতে দিন পৃথিবীতে। ভালোবাসার অনেক কমতি পরেছে পৃথিবীতে। মানুষ মানুষকে আর ভালোবাসে না। যতটুকু ভালোবাসা ওই ছেলেটির আছে তার প্রতি সম্মান দেখানো উচিত আমাদের। আমার অনুরোধ, দয়া করে ওকে ছেড়ে দিন।’

 

ছেলেটিকে পুলিশ থানা থেকে ছেড়ে দিয়েছিলো, পকেটে থাকা জিনিসগুলোসহ। দুটা স্যাঁতস্যাঁতে সিগারেট, একটা দেশলাইট, একটা পেনড্রাইভ, তিনটা চাবি নিয়ে ছোট ছোট পায়ে বেড়িয়ে আসলো ছেলেটি। থানার বাইরে প্রচন্ড রোদের তাপ। ওতখন তিন-চারবার দেশলাইটে ঘষে ঘষে জ্বালিয়ে নিলো সিগারেট। ও জানতো পুরোনো প্রানহীন সিগারেট খেলে মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা করে। কিন্তু এটা জানতো না সিগারেট খেলে সৃষ্টিশীল চিন্তার জন্ম হয়। কিন্তু এটা জানতে সিগারেট স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তবুও জেনেশুনে বিষ পান করে যাওয়ার নামই জীবন।

×