Short Stories

অরণ্য প্রমাণ করেছিল, সে আসলে জঙ্গল না

By Mehedi Shamim | 15 Feb, 2022

অরণ্য প্রমাণ করেছিল, সে আসলে জঙ্গল না

শকুনী লেক ঘেঁষা মানুষগুলোর আচরণ নিরন্ত বদলে যাচ্ছে। বিপদাপন্ন ও বিষন্ন বালকের তাই ধারণা। রমরমা কয়টা দিনের চুম্বকাংশ সিনেমার মতো তার সামনে কে যেন ফ্রেমে ফ্রেমে সাজিয়ে দিচ্ছে। সে অনুভব করার চেষ্টা করছে মানুষের কষ্ট হলে কি রকম আচরণের দিকে সে বেশি ঝুঁকে পড়ে। এভাবে হেঁটে যেতে থাকলে হয় তো সে সিমানা ছাড়িয়ে যেতে পারবে খুব তারাতারি। কিন্তু সে সিমানার মধ্যেই থাকবে। বালকের নাম অরণ্য। অবনী তাকে জঙ্গল বলে ডাকতো। জঙ্গলে অবনীর প্রবেশ ঘটে দীর্ঘ এক মাস আগে। ওই কটা দিনের ঘটনা নিয়ে অরণ্য একটা মহাউপন্যাস লেখার বিস্তর ভাবনায় লেকের পাড়ময় হেঁটে বেড়াচ্ছে। এখানে এসেই সে সাজিয়ে নিচ্ছিলো তার গল্পের কাঠামো। হঠাৎ কাহিনী সাজাতে বসে। অরণ্যেও স্থির চোখ ক্ষত করছে লেকের জল।

 

যখন থেকে বদলে যাচ্ছিলো অরণ্যের সাধারণ দিনগুলো। একদিন একজন লং স্কাট পড়া ফর্শা রমনী নাকের ডগা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো। এমন রমনী সে ঘর থেকে বের হলেই দেখে। কিন্তু মনযোগ দিয়ে দেখে যখন রমনীর পরণে কালো রঙের পোশাক আর চোখে কাজল থাকে। দুটোই উপস্থিত ছিলো। যথারীতি হাটর্ফেল করার মতো রমনী। কিন্তু অরণ্য ভীষণ শক্ত ছেলে সহজেই অন্যসব ব্যাপরে ফেল করলেও যখন হার্টএর ব্যাপার আসে তখন আর ফেল করে না। অরন্য পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করলো। তার এরকম পিছু নেয়া নতুন ঘটনা নয়। কিন্তু পরিবর্তনটা হলো স্থায়ীত্বের জায়গায়। রীতি ভঙ্গ করে অরণ্য স্থায়ীভাবে মেয়েটির পেছনে হাঁটার সময়টা বাড়িয়ে দিলো। আর বিপদটা হলো ওখানেই। ইতোমধ্যে অরণ্য নিজের মধ্যেই মেয়েটির জন্য প্রেমের পাহাড় বানিয়ে ফেললো। কিন্তু অরণ্য তখনো কিন্তু জানতে পারে নি মেয়েটি পাহাড় না সাগর পছন্দ করে। অতসব না ভেবেই অরণ্য জল্পনা কল্পনার জটলা পাঁকিয়ে হুলুস্থল কর্ম ঘটিয়ে ফেলার পায়তারায় ব্যস্ত। 

ইতোমধ্যে অরণ্য মেয়েটির কয়েকটি ছবি তুলে নিয়েছে। বাসায় এসে ছবি জুম করে গলায় ঝুলানো আই ডি কার্ড দেখে বের করে ফেলেছে মেয়েটি কোন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ে। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে সারাটাদিন বসে বসে অপেক্ষা করেছে অরণ্য। কখন মেয়েটি আসবে। হঠাৎ মেয়েটির দেখা মিলে। এবং জানতে পারে তার কখন কখন ক্লাস। ওইদিন আর তেমন কিছু করতে পারে না অরণ্য।

 

কোন এক সকালে... 

প্রেম শুভ। প্রেমে ইতিবাচক সাঁড়া পাবেন। আজকে আর্থিক ক্ষয়-ক্ষতি হবার অপার সম্ভাবনা। এই ছোট ছোট বাক্য একটি দৈনিকের রাশি ফল থেকে পড়েই সাহস যুগিয়েছিলো। সময়ও তার পক্ষেছিলো। কতগুলো টেকনিক মাথায় থাকলে খুব সহজেই রাশিফল লেখা যায়। আপনার অবশ্যই ছোট্ট ছোট্ট বাক্য গুছিয়ে লেখার অভ্যাস থাকতে হবে। আপনি তো জানেনই প্রেম শুভ হলে আর্থিক ক্ষতি হবেই।আর তাই প্রথমে একটা কথা বলে, ওই কথা অনুসারে চোখ বন্ধ করে বাক্যগুলো সাজিয়ে নিলেই হয়ে গেলো রাশিফল।

অতো সময় এখন অরণ্যেও হাতে নেই । তার চোখেমুখে স্বপ্নের ফোয়ারা। সে এখন ভীষণ ব্যস্ত। সমস্ত সময় তো এখন অবনীর জন্য। হঠাৎ করেই মেয়েটির মুখোমুখি হবার সৌভাগ্য অরণ্যের হলো। তার কাছে তো সাহসের ছোট্টবাক্য আছেই। দাঁড়িয়ে থাকা দুটো মানুষ কি করবে তাই ভাবছে আর চোখ নাড়ানাড়ি করছে। কিন্তু অরণ্য সময় নষ্ট করতে নারাজ। 

অরন্য : তোমার জন্য আমি সব পারি। মরতে পারি। বাঁচতে পারি। দেখতে পারি। শুনতে পারি। সব। সব। 

অবনী : কেন ? 

অরন্য : তোমাকে ভালোবাসি। খুব। খুব... অবনীর ভীষণ ঘাবরে যাওয়ার কথা। কিন্তু অবনী জানে কখন কি করতে হয়। বেশি সময় নেয় নি। মাত্র ৪৫ সেকেন্ড এ সমাধান। সুভাষ মুখোপাধ্যায় কবিতা ‘একটি সংলাপ’। মনে মনে মুড়ি ভাঁজার মতো ভাঁজতে থাকে।

অবনী : আচ্ছা তুমি আমার জন্য তো সব করতে পারো তাই না ? তবে.. 

অরন্য : অবশ্যই। তবে কি বলো.. 

অবনী : কাল বিকেলে লেকের পাড়ে এসো। 

অরণ্য : এতো খুব সহজ। অবশ্যই আসবো। কাল দেখা হচ্ছে। 

 

পরবর্তি বিকেল... 

অবনীর প্রস্তাব। বিকেল ভরা মানুষ। লেকের মধ্যে ঝাঁপ দাও তো। অরণ্য এই অসম্ভব সুন্দরী মেয়েটার জন্য সত্যিই সব কিছু করতে পারে। ছেলেটার ২১ বছর জীবনে কাউকে নিয়ে একরাত দু তরফা ভালোবাসার চিন্তা আসে নি। লেকের পানিতে সাঁতার কেটে তার বন্ধুদের সামনে একজন দুগ্ধবতী গাধায় পরিণত হয়। যাকে যখন তখন দোহন করা যায়। অরন্য এখন বাসায় লেকের নোংরা পানি ভালো পানি দিয়ে পরিস্কার করছে। ফোন বেজে উঠতেই দৌঁড়ে গিয়ে ধরলো।

অরণ্য : দেখলা তো। আমি পারলাম।

অবনী : দেখলাম। কিন্তু আজ সারারাত তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করছে। কি করা যায় বলতো? 

অরণ্য : তাই। এটা তো কোন ব্যাপার না (অদ্ভুদ আনন্দ ভীড় করেছে অরণ্যের ঘাড়ে) 

অবনী : তাহলে একটা কাজ করো আমার রুমের বেলকুনি সোজা একটা জায়গা আছে ওখানে তুমি দাঁড়িয়ে থাকবে। আমার যখন ইচ্ছা হবে তখনই তোমাকে দেখবো সারারাতজুড়ে। খুব মজা হবে। তাই না? 

অরণ্য : ঠিক আছে ! (কিছুটা ঘাবরে যাওয়ার মতো অবস্থা)। রাত বাড়তে থাকে। অরণ্য মশার সাথে ঝগড়া করে। তারার সাথে কথা বলে। মোটামুটি একজন সদ্য কবি রূপে তাকে দেখাচ্ছে। সকাল হতেই অরণ্য’র অসুস্থ শরীর। বিছানার সাথে গড়াগড়ি খেতে থাকে।

কিন্তু অবনীর নতুন ফরমায়েশ। গ্রাম থেকে খেজুরের রস নিজ হাতে এনে তাকে তাজা রস খাওয়াতে হবে। শরীরের মধ্যে খিটখিট করলেও অরণ্য ছুটে যায় রস আনতে। সারা শরীর ব্যাথা নিয়ে অরণ্য ভোরের আলো দেখছে আর অবনী বসে বসে রস পান করছে। দিন যেরকম করে যাচ্ছে অবনীর ফরমায়েশ তত বেড়ে যাচ্ছে। এটা করো। ওটা করো। এই ভাবে ২৯ তম দিনে এসে অরণ্য ও অবনী একতলার এক ছাদে। বাংলা সিনেমার শেষ দৃশ্যে। বাড়িটার দুইপাশে নোংরা পানির কুয়া, অন্যপাশে বালি ও ইটের খোয়ার স্তুপ। সামনের দিকে গাড়ি পার্কিং করা।

অবনী চোখ বড় বড় করে বললো,অরণ্য এখান থেকে ঝাঁপ দাও। অরণ্য মনে মনে ভাবছিলো। কোন এক ডাইনির পাল্লায় পড়লাম। এবার বুঝি আমার সর্বনাশে মাথায় বারি পরলো। অরণ্য অবশ্য থেমে থাকে নি একটা প্রশ্ন করেছিলো, ‘কোন দিক থেকে দিবো?’। অবনি বলেছিলো যেদিকে থেকে তোমার ইচ্ছা। সে চারপাশটা দেখে নিলো প্রথমে; তারপরে দিয়ে ছিলো একটা লম্ফ। ক্ষয় ক্ষতির পরিমাণ উদ্ধার করা যায় নি। তবে মাথার খুব কাছে এক রমনী বসে ছিলো। তার চোখে কাজল আর পরণে কালো রঙের পোশাক। হাত বুলাতে বুলাতে বলছিলো,‘কাল মচকানো পা নিয়ে একটু লেকের পাড়ে আসবে? আমি তোমাকে ফুচকা খাওয়াবো। আর তোমাকে একটা কথা বলবো।’

অরণ্য তখন পুরোপুরি জেনে বা বুঝে ফেলেছিল। এবার আমি পরীক্ষায় পাশ করেছি। লেখক হিসেবে আমার এখানে দোষ নেই অরণ্য অজান্তেই নিজেকে একজন পরীক্ষার্থী ভেবেছে। আমি তাকে এমন কোন চরিত্র দিতে চাই নি।

যেহেতু একটা পরীক্ষা চলছে তার শেষ পর্যন্ত তো যেতেই হবে। আজকাল বাংলা সিনেমায় একটু চমক দেয়ার জন্য কখনো শেষ দৃশ্য নিয়ে একটু এদিক সেদিক দৌঁড়া-দৌড়ি করে।

সেরকম একটা চেষ্ঠা এখানে অবনী করেছে। ৩০ তম দিনে অরণ্য পা খোঁড়াতে খোঁড়াতে লেকের পাড়ে এসে দেখলো। এক বেহেশস্তি পরি এসে বসে আছে। অরণ্যর কখনোই লেককে এতোটা খারাপ লাগে নি এখন যতটা লাগছে। কারণ সব সুন্দর এখন অরন্যের চোখে অবনী। গাঢ় কালো রঙের শাড়ি আর কাজলে চোখ সেজেছে। পাশে বসেই অরণ্য হাত ধরে বসলো অবনীর। মনে মনে ভাবতে শুরু করলো এতোটা সাহস হলো কবে। আজ কিন্তু সে রাশিফল পড়ে আসে নি। ভেতর থেকেই তাকে কেউ একজন হাতটা জাগিয়ে অবণীর হাতে মিশিয়ে দিলো।

 

কিন্তু অবনী তো বিষন্ন। নিষ্ঠুর। এখনো চোখটা চোখে রাখে নি। নাকটা নাকে রাখে নি। চুলটা চুলে রাখে নি। আঙুলটা আঙুলে রাখে নি। 

তেমন কোন অলস কথা না বলে, অবনী সরাসরি তার বাসা থেকে গুছিয়ে আনা আলোচনায় চলে গেলো। যেই আলোচনার জন্যই হয়তো ঘটেছে এইসব ঘটনা।

অবনী : অরণ্য, তুমি কি জানো? হুকুম তামিল করে কে? 

অরণ্য : কেন, ক্রীতদাস।

অবনী : তুমি খেয়াল করেছো প্রথম থেকেই তুমি আমার হুকুম পালন করছিলে। তুমি বলছিলে আমি যা বলবো তুমি তাই করবে। 

অরণ্য : হ্যাঁ। আমি তো এখনো পর্যন্ত তাই করছি। কোন ভুল হলো আমার।

অবনী : না। একদম না। তুমি শতভাগ পেরেছো। কিন্তু তুমি জানো হুকুম পালন করা হলো ক্রীতদাসের কাজ। তুমি আমার ভালোবাসার মানুষ না। ক্রীতদাস। ক্রীতদাসের মতো তুমি আমার সব হুকুম পালন করেছো। অরণ্য, আমি তো কোন ক্রিতদাসকে ভালোবাসতে পারি না।

 

তখন অরণ্য হয়তো বলেছিলো ভালোবেসে আমি ক্রীতদাসও হতে পারি,অথবা বলেনি। তবে সত্যি সে ভালোবেসে ক্রীতদাস হতে পারতো। ভালোবেসে নদী হতে পারতো। সাগর হতে পারতো। পাহাড় হতে পারতো। একটু বাড়াবাড়ি পর্যায়ের ভালোবাসা জন্মেছিলো মেয়েটির জন্য।

অরণ্য কখনোই জানতো না, সে কাউ কে এতোটা ভালোবাসবে। হঠাৎ অবাক হলো অরণ্য। অরণ্য কেমন এক বিমূর্ত বালক। হঠাৎ সচেতন ভাবেই ছাড়িয়ে নিলো নিজের হাত। তার মালিকের শরীর থেকে অর্থাৎ যার ক্রীতদাস ছিলো এতোদিন অরণ্য।

অরন্য অনুভব করলো তার শরীরের ওজন অনেক বেড়ে গেছে। সে উঠে দাঁড়িছে কিন্তু হাঁটতে পারছে না। সমস্ত শরীরের ওজন নেয়ার মতো শক্তি তার হয়তো নেই। সে শুধু ভাবতে পারছে। তা যেকোন কিছুই হোক। নিরন্ত ভেবে যাচ্ছে। ৯ মিনিটে তার সমস্ত ভাবনা শেষ। নতুন কোন ভাবনা তার মাথায় নেই। সে শুধু এইটুকু ভাবছে তা হলো শকুনী লেক ঘেঁষা মানুষগুলো নিরস্ত বদলে যাচ্ছে। যাক না তাতে অরণ্য অথবা অবনীর কোন লাভ নেই।  

 

গল্পটি শেষ হচ্ছে না। অমিমাংসিত থেকে যাচ্ছে অনেককিছু। সবাই বড় ধরণের কষ্ট পেলে লিখতে বসে তার কষ্টের  বর্ণনা। কিন্তু সেই লেখাগুলো ভবিষ্যত কি এমন চিন্তা কেউ করে না। ধরে নিলাম অরণ্য একজন লেখক হয়ে গেলো। তার জীবন নিয়ে লিখে ফেললো একটা উপন্যাস।

অন্যদিকে অবনির কি হবে, সে কি ছেলেদের থেকে পালিয়ে বেড়াবে?

নাকি নিজের পছন্দ মতো কারো সাথে প্রেম করবে। আচ্ছা যদি অবনির পছন্দের ছেলেটা অবনিকে এই ভাবে এ্যাসাইনমেন্ট দিতে থাকে তবে অবনি কি সেই কাজগুলো করবে যেমনটা অরণ্য করেছিলো। কারণ অরণ্য ভালোবাসা পাওয়ার জন্য এইসব করেছিলো। অবনিকেও তো ভালোবাসা পাওয়ার জন্য এইসব করা লাগতে পারে। কারণ ভালোবাসা ছাড়া মানুষ অসহায়।

অবনির জীবন তার হাতেই ছেড়ে দিলাম। সে কিভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে সেটা তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। খুব সম্ভবত অবনী জানে না, ক্রীতদাস কখনোই মনটা দেয় না; শুধু শ্রম দেয়। মন এবং শ্রম দুটা অনেক আলাদা বিষয়। এই দুই কেন্দ্রীক শব্দদুইটা দুই দিকেই থাকুক তাতে অবনীর কিছু যায়-আসে না।

 

পুনশ্চ : পাঠক ভাবুন তো। এখানে অরণ্য নাকি অবনীর দোষ। তেমন চিন্তা করতে হবে না। আমরা তো জানি ভালোবাসায় দোষ বলে কিছু নেই। তবে কি অবনী অরণ্যকে ভালোবেসে ছিলো। যদি সত্যিই ভালো না বাসতো হয় এই রকম জীবন্ত সত্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতো না। ভালোবাসা এবং ক্রীতদাস এক জিনিস না। ভালোবাসলেই দাস হয়ে যেতে নেই। এটা না করে, ইচ্ছা করলেই তো অরণ্যকে সারাজীবন চষে বেড়াতে পারতো অবনী।

কিন্তু অবনী হয়তোবুঝতে পেরেছিলো অরণ্য জঙ্গল না। আর তাই অরণ্যকে তার নিজ নামে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়ে গেলো অবনী।

×