Short Stories

সেই জোয়ারের লজ্জা নেই ॥ মেহেদী শামীম

By Mehedi Shamim | 16 Jan, 2022

সেই জোয়ারের লজ্জা নেই ॥ মেহেদী শামীম

মমিনের মাথার মধ্যে মাগুর মাছের পুকুর। থৈ থৈ করছে চিন্তার ঝাঁক, সাঁতরে বেড়াচ্ছে গোটা মগজজুড়ে। সিগারেটের ভেতর থেকে তামাকের পাতাগুলো শূন্য করার কাজে ব্যস্ত তার হাত। কিছুক্ষণেই সমস্ত সিগারেট শূন্য। তামাক আর গাঁজার মিহি পাতাগুলো ঠেসে ঠেসে সিগারেট ভর্তি করা ইতোমধ্যেই শেষ। মমিন বিশেষ দিনে বেনসন সিগারেটের মধ্যে গাঁজা ঢুকিয়ে খায়। একটু বেশি মজার পাওয়ার জন্য।

গাঁজার ইস্টিক তৈরি হয়ে গেছে। দেশলায়ের আগুনে চিরচির করে পুড়ছে সিগারেট। ভাঙা জানলা দিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে এদিক সেদিক গাঁজার গন্ধ। স্বাভাবিক জীবন-ভাবনা থেকে সে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে নিজেকে। ঘরের মধ্যের অন্ধকার চারপাশের দেয়াল ভেঙে ছুটে গেছে চায়ের দোকান পর্যন্ত। চায়ের দোকানও আবছা আবছা লাগছে। সবকিছুর মধ্যেই কেমন হালক রঙের কায়া হয়ে উঠছে। ভাত পঁচা পানি অর্থাৎ বাংলা মদের গন্ধ ঘরের বাতাসের সাথে ঘনিষ্ট হয়ে গেছে। মশার ভন ভন সুরেলা সংগীতে আর বিরক্ত হচ্ছে না মমিন। শুধু মমিন কেন সমস্ত পৃথিবীই তখন অস্বাভাবিক।

এই ঘরটা যতই ঝাড়– দেয়া হোক না কেন ময়লা হয়েই থাকে। ময়লার সাথে এই ঘরের একটা নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। দেয়াল খসে খসে বালুর সাথে চুন রঙ মাখামাখি অবস্থায় লটকে পড়ে ফ্লোর জুড়ে। একটা অলৌকিক গন্ধে ভূতুরে হয়ে উঠছে ঘরের নিজস্বতা। এই ঘর গিলে খেয়েছে অজস্র সূর্যের তাপ।

 

হিপোক্যাম্পাস শব্দটির সাথে পরিচয় অনেক আগেই ডাক্তার জহিরের। তিনি এখন দায়িত্বরত অটোপসি ডাক্তার। কিন্তু সে কিছু সময় হিপোক্যাম্পাস নিয়ে চিন্তা করবে। মানুষের মষ্কিকে হিপোক্যাম্পাস অংশে স্মৃতি ধরে রাখার ক্ষমতা থাকে এবং এই অংশ মানুষকে সৃজনশীল চিন্তা করতে সাহায্য করে। আর এই দুটি ক্ষমতা সক্রিয় এবং শক্তিশালী করতে হলে হিপোক্যাম্পাসে নিউরোনের জন্ম হতে হয়। যখন কেউ যৌন সঙ্গম করে তার হিপোক্যাম্পাসে প্রচুর নিউরোনের জন্ম নেয়। জহিরের মাথায় একটি প্রশ্নের গোল বারবারই গোল-পোস্টের কাছে এসেই ফিরে যাচ্ছে মাঠের মাঝখানে। সেই প্রশ্নটা কিছুটা এরকম একজন প্রতিতা প্রতিদিন কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ বার যৌন সঙ্গম করে তবে ওদের মধ্যে স্মৃতি ধারণ করার ক্ষমতা অথবা সৃজনশীল চিন্তার উৎকর্ষতা তো উচ্চ পর্যায়ের হওয়া উচিত। কিন্তু জহিরের হাতে তেমন সময় নেই ওইখানেই তার চিন্তায় ফুলস্টপ দিয়ে রাখলো। তবে পাঠকের সুযোগ আছে এই বিষয়ে বিশদ চিন্তা করার।

 

হাসপাতালের ফ্লোর জুড়ে শয্যায়িত এক ডজন মৃত শরীর। আঘাতে জর্জরিত আরও মৃতের সংখ্যার অপেক্ষায় বসে আছে বেলকুনির এক পাশে মমিন অন্য পাশে জহির। মমিন ও জহির যখন ময়নাতদন্ত করে ওই সময়ে তারা দুজন দুজনের দিকে খুব বেশি তাকায় না। ‘ময়নাতদন্ত’ শব্দটি নিয়ে অনেক গুজব রটিয়েছে মমিন কখনো বলেছে, এক গ্রামে ময়না নামে একটা সুন্দরী মেয়ে ছিলো। তাকে তার স্বামী যৌতুকের জন্য মেরে গলায় ফাঁস দিয়ে রেখেছিলো। তার মৃত্যুর কারণ খোঁজার জন্য ডাক্তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে এই পরীক্ষা-নিরীক্ষার নাম দিলো ‘ময়নাতদন্ত’। আবার কখনো মমিন বলেছে, ময়না পাখি খুব কালো অন্ধকারে তাদের দেখা যায় না। আর কোন মৃত্যুর পরে প্রথমেই বোঝা যায় না কিভাবে মৃত্যু হলো। তাকে খুঁজে বের করতে হয়। যেমন ময়নাপাখিকে অন্ধকারে খুঁজে বের করতে, তেমনই খুনের রহস্য বের করার জন্য যে তদন্ত করা হয় তাকে ময়না তদন্ত বলে।

এই কাজে যখন দুজনে আসে খুব নীবিড়ভাবে দায়িত্ব পালন করে যায়। তাঁরা দুজনেই দুটি আলাদা প্রক্রিয়ায় নিজেদের অস্বাভাবিক করে। তারপরেই কাজে নেমে পড়ে। আজ আরও কিছু সহকর্মীর দরকার হবে। মৃতের সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে দিয়ে।

মমিন এবং ডাক্তার জহির পরিপূর্ণ অস্বাভাবিক। কিন্তু তাদের অভিজ্ঞতা প্রখর সবকিছুই তারা নখ দর্পণে নিয়ে ফেলে অল্প সময়ের মধ্যেই। অস্বাভাবিকতাই তাদের বিচক্ষণতার পথে হাটতে শেখায়। মমিন ও জহিরের মধ্যে এক ধরনের সম্মিলন রয়েছে তারা দুজনই পারস্পারিক ইশারার ভাষায় দক্ষ।

এই শহর আজ সকাল থেকেই অন্ধকারে ডুব মেরেছে। চোখে আচ্ছন্ন দেখছে শহরের সমস্ত মানুষ। সূর্য বোধহয় আলো সঞ্চয়ে ব্যস্ত হয়েছে। ডাক্তার জহির ঘুম থেকে উঠে সকালের শেষের দিকে। মমিনের আবার একটু তাড়াতাড়ি উঠতে হয়। তার স্ত্রী আবার টাঁটকা-তাজা বাজার ছাড়া রান্না ঘরে যায় না। আজ সকালেই ডাঁটা শাঁক কিনেছে মমিন, তাজা ডাঁটা শাঁক। ঠিক যেমন তাজা তার সামনে একটি লাশ। লাশের চরিত্রে আছেন একজন তরুণী। তার কোন পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি। মমিন খুব ভালো করেই জানে এই হত্যার ঘটনা। কেন মারা হয়েছে এই তরুণীকে অথবা সবাইকে। তাও তাকে এই লাশ কেঁটে-ছিঁড়ে ডাক্তারকে প্রতিবেদন লিখতে সহযোগিতা করতে হবে। হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন করার জন্য। মমিন প্রতিদিন হত্যার রহস্য খোঁজে মানুষের মৃত শরীরের মধ্যে। তল্লাশী করে বেড়ায় সমস্ত শরীর কোথাও কোন আঁচর অথবা আঘাতের দাগ দেখলেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে ওইখানে। কাজগুলো দ্রুত শেষ করতে হবে বলেই মুখ না দেখে-ই কাঁটা শুরু করলো মমিন। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় চোখ ছুটোছুটি করতে করতে মমিনের চোখ আটকালো মেয়েটির বুকে শক্ত দাঁতের কামড়ে ক্ষত হওয়া চিহ্নে। পরিচিত হয়ে উঠলো মেয়েটি মমিনের কাছে। গতরাতেই সে এই মেয়েটির সাথে শুয়েছে। গতরাতে কেন প্রতি সপ্তাহে প্রায় তিন-চারবার মেয়েটির সঙ্গী হয় মমিন। কিন্তু মমিন তো পরিপূর্ণ অস্বাভাবিক। সে আবেগে আপ্লুত হয় না। হওয়ার সুযোগও নেই। তবে তাকে পুলিশের খপ্পরে পড়তে হবে। কিন্তু মানুষের চোখের পানির নিয়ন্ত্রণ বেশির ভাগ সময়েই মানুষের কাছে থাকে না। হু হু করে মমিনের বুঁকের মধ্যে কান্নার দমকা হওয়া দাপাদাপি করছে। দম আটকে যাচ্ছে। শ্বাস নিতে পারছে না। বুকের এই ক্ষত মমিন ইচ্ছা করে দেয়নি। পারুল তাকে বাধ্য করেছে এই ক্ষত করে দিতে। মমিনের সঙ্গ পারুলকে নৈসর্গিক আনন্দ দিতো। গতরাতেই মমিনকে অনুরোধ করে বলে তুমি আমার বুকে একটা কামড় দিয়ে ক্ষত করে দাও। সে দিতে চায়নি। মমিনের কষ্ট হচ্ছিলো পারুলের শরীরে ক্ষত করতে। পারুলের বুক ছিলো বাজারে পনিরের গোল স্তুপের মতো। ওইখানে আঘাত না, ঠোঁটের ছোঁয়া-ই দিতে চায় মমিন। কিন্তু পারুলের প্রবলচাপে মমিন বাধ্য হয়েছে ক্ষত করতে।

আজ পারুলের কোন নাম নেই; কেউ তাকে সনাক্ত করতেও আসেনি। মমিন কিছুক্ষণ জানালার ফাঁকা দিয়ে একটা মূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটিকে মৃত্যুর সময়ে তার পরিচয়টুকুও দেয়ার সাহস মমিনের নেই। যেই শরীরকে নরম স্পর্শ দিতো যে হাতে; ওই হাতেই কাটতে হচ্ছে পারুলের শরীর। পারুলের নাভির দিকে যখন মমিনের খসখসে দাঁড়ির খোচা লাগতো তখন পারুল আচমকা দাপাদাপি শুরু করে দিতো। কেমন উত্তেজিত হয়ে উঠতো। ঝাঁপটে জড়িয়ে ধরতো মমিনকে। কিন্তু সেই নাভি ভেতর আর বিদ্যুৎ নেই। জ্বলে ওঠা আগুন নেই। সমস্ত শরীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা শেষ। মমিন এবার পারুলের শরীরে মিহি সেলাই করছে। ধবধবে ফর্শা চামড়াগুলো টেনে টেনে জোড়া লাগিয়ে লাগিয়ে একটা আস্ত পারুল তৈরি করছে। পারুলের শরীর যেন নকশী কাঁথা তাকে একটা গঠন দেয়ার জন্য মমিন চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই আস্ত হয়ে উঠছে না। মানুষের শরীর সেলাইয়ে সে দক্ষ কারিগর কিন্তু যে শরীর সে সেলাই করছে এই শরীরের অঙ্কের যোগফল অতি জটিল।

 

কিছুদিন আগের থেকেই সবাই টের পেয়ে গিয়েছিলো শহরে একটা গণ্ডগোল লাগবে। ভাঙচুর হবে। উচ্ছেদ করা হবে একটা পাড়া। যেখানে চাহিদা পূরণ করা হয় শহরের বিবাহিত, অবিবাহিত প্রায় সমস্ত পুরুষদের। কিন্তু সেখানেই আর একটি চাহিদার জন্ম নিয়েছে। একটি চাহিদার সাথে আরও একটি চাহিদার যুদ্ধ চলছে। অর্থনীতি বলে সম্পদ সীমিত; এই সীমিত সম্পদের মধ্যেই যোগান-চাহিদার যুদ্ধ হয়। যে টিকে থাকে সেই বেঁচে থাকে। সমাজসেবী হারুন মাতবর, জলিল মাহমুদরা পাড়াটি সংরক্ষণের জন্য চার দেয়ালের ভেতরে বসেই উদ্যোগ তৈরি করছে, উদ্যোগ ভাঙছে। কিন্তু মুখ ফুটে বলছে না কিছুই। শহরের এই উদ্যোগের বৃষ্টিপাত হলে কাদাময় হয়ে উঠবে সমাজসেবীরা। তাদের নিজস্ব মূল্যবোধ দেয়ালেবন্দি।

অন্যদিকে কিছু ধর্মপ্রাণ মানুষের উদ্যোগ মাইকের আওয়াজ হয়ে ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। এই উদ্যোগের বিরোধীতা করে না কেউই অপবাদের ভয়ে। মমিন মাঝে মাঝেই চায়ের দোকানে চেষ্টা করে বিরোধীতা করার। বলার চেষ্টা করে, না এটা ঠিক না; মানবাধিকার বলে তো কিছু থাকলো না। চায়ের দোকানের কেউ কেউ চুপ হয়ে যায়। কেউ কেউ মমিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। মমিন খুব দ্রুত চায়ের দোকান ত্যাগ করে বিষয়টি হালকা থাকতে থাকতেই।

আবার আর একটা চায়ের দোকানে বসে। আলোচনায় উঠানোর চেষ্টা করে আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছে তারা কি সত্যিই ধর্মপ্রান মানুষ। একবার একটু ঘেঁটে দেখেন তো। নাকি অন্য কোন মতলব আছে। চায়ের দোকানের মানুষগুলো ঘিরে ধরে মমিনকে। মমিনের কণ্ঠের স্বর আর শোনা যায় না। দশ-বিশটা কণ্ঠ তাকে দাবিয়ে দেয়। চায়ের দোকান থেকে চারপাশে ছুটে আসে মোটা আওয়াজ, ‘যেই মতলবই থাকুক শহরটা পাপমুক্ত হবে’। কিন্তু মমিন এই লোকগুলোর মধ্যেই অনেক পাপীকে খুব ভালো করেই চিনে। সাইকেলের প্যাডেলে দ্রুত পা চালিয়ে মমিন বাসায় ফিরে তাজা তরকারি নিয়ে। কিন্তু মমিনের ঘরের মধ্যে আজ আরো একটি চায়ের দোকান উদ্বোধন হয়েছে। এই চায়ের দোকানে সব সময় চিনির পরিমাণ বেশি দেয় চায়ে। চা তখন সরবতে পরিণত হয়। মমিন যখন পারুলের সাথে দেখা করতে যেতো তখন পারুলের ঘরের পাশে চায়ের দোকানে এমন সরবত ধরনের চা বিক্রি করতো। ওই চায়ের ক্রেতাদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলো ডাইলের নেশাখোর। কিন্তু তার ঘরের চায়ের দোকানে কেউ ডাইল খায় না। তবে কেন এমন সরবতের মতো চা হয় ঘরে এই প্রশ্নের উত্তর মমিন আজকে পাবে না। এমনকি ভবিষ্যতে পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই। তাছাড়াও মমিনের প্রশ্ন করার অধিকার নেই। তাকে শুধু উত্তর দিতে হয় প্রশ্নের। মমিনের বউ লাইজুর মুখোমুখি মমিন। মমিন যখন লাইজুরে সামনে দাঁড়ায় তখন মমিনের মধ্যে ঢাকা শহরের হর্নগুলো বাজতে থাকে প্যা.. পু.. প্যাঙ..।

 

ঘরের মধ্যে উচ্চ স্বরে স্টার জলসায় চলছে ভালোবাসা ডট কম। টিনের চিকন ফুটা দিয়ে আলোর একটা তীর এসে গেঁথেছে মমিনের পানজাবিতে। লাইজুর শরীর থেকে পেঁয়াজের তীক্ষ্ণ ধাচ্ এসে নাক দখল নিয়েছে মমিনের। একদল হাঁস এসে সমবেত হয়েছে জানালায়। মাঝে মাঝে মমিনের মনে হয় সে একটা লঞ্চে বসবাস করে। তার ঘরের তিনপাশেই পানি। হাঁস, টাঁকি মাছ, সিং মাছ, পুঁটি মাছ এসে উঁকি-ঝুঁকি মারে জানালায়। মাঝে মাঝে বড়শি দিয়ে ঘরে বসেই মাছ শিকার করে মমিনের ছোট ছেলে সবুজ। কিন্তু সেই মাছ ঘরে রান্না করতে নারাজ লাইজু। সে বলে এই মাছ নাকি গুহা পানির মাছ। এই মাছগুলো খাদ্য তালিকায় প্রথমেই নাকি আছে মানুষের গু। আর গুহা পানির মাছ তার কড়াইতে সে রাঁধবে না। লাইজু সুস্বাস্থ্যবান একজন মহিলা। তার সমানে মমিন ছোট-খাটো পুরুষ। লাইজুর পড়নের মেক্সির কাপড় দিয়ে তিনটা বালিশের কাভার বানানো সম্ভব। কিন্তু মমিনের শার্টের কাপড়ে একটা বালিশের কাভারও হবে না। লাইজু একদিন তুমুল ঝগড়া বাঁধিয়েছে এই নিয়ে। সে চিৎকার করে বলে তোমার জামা কাপড় এত্তো ছোট্ট ছোট্ট তা দিয়ে কিচ্ছু হয় না। তুমি কোন কামেই আসো না সংসারের। মমিন খাটের উপরে বসে ঘাড় উঁচু করে লাইজুর দিকে তাকিয়ে আছে। মাছির ভন ভন সুরে বিরক্ত লাইজু।

 

ইঙ্গিত-ভঙ্গিতে লাইজু তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে তুমি কি সব বলে বেড়াও বাজারে। তোমার সমস্যা কোথায় ?

তোমার উদ্দেশ্য কি ?

তুমি কি ওই পাপের মধ্যে যাও?

মমিন এই প্রশ্নগুলো শুনে আবার পারুলকে নিয়ে চিন্তা করে। পারুল কত সোজা-সাপটা কথা বলে। কোন কিছুই ইঙ্গিত দিয়ে বোঝায় না। যা বলে, কিলিয়ার-কাট কথা। আর লাইজু আমার দলিল করা স্ত্রী সে আমার সামনে খোলাসা করে কোন কথা বলতে পারে না। খালি লজ্জা পায়। জগৎটা আসলেই উল্টা। মমিনের কানের মধ্যে একটা মাঝারি ধরনের আওয়াজ হয়। মমিন টের পায় লাইজু খুন্তি দিয়ে টেবিলে আঘাত করেছে। তারপরেও মমিন কোন উত্তর দেয়নি লাইজুকে, অনেক সাহস সঞ্চয় করে লাইজুর দিকে তাকে একটা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়-

আচ্ছা, তুমি চায়ে এতো চিনি দাও কেন?

 

মমিনের অনেকগুলো রাত না ঘুমিয়ে কাটাতে হতো। লাইজু পাশে শুয়ে থাকলেও লাইজুকে স্পর্শ করার অধিকার মমিনকে দেয়া হয় না। মমিন যেদিন বেতন পেতো ওইদিনই মমিনের স্বর্গীয় রাত। সমস্ত ঘর মমিনের কাছে মধুময় হয়ে উঠতো। মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষের দিকেই মমিন একা হয়ে যেতো। তখনিই মমিন পারুলকে খুঁজে পায়। পারুলই মমিনকে উদ্ধার করে। মমিন অনেক রাতেই গ্রাম থেকে আসা কাজের মেয়েটার ঘরে ঢুকে পড়তো। কিন্তু কিছু করতে পারতো না ফিরে আসতো। কারণ প্রতিদিন সকালের সমস্ত সংবাদ মাধ্যমের পাশাপাশি তার একটি নিজস্ব সংবাদ মাধ্যম আছে, সেখানে কিছু খবর প্রকাশিত হয়। সেই খবরগুলো সে নিজেই পড়ে। তার এই সংবাদ মাধ্যম তাকে ভীষণ ভয়-ভীতি দেখায়। ওই সংবাদপত্রই মমিনকে সামগ্রিক অপকাজ থেকে দূরে রাখে। তবে সে পারুলের কাছে যাওয়াকে কখনোই অপকাজ হিসেবে দেখেনি। এই বিষয় তার সংবাদপত্রও আপত্তিকর কোন খবর প্রকাশ করেনি। কেন করেনি এমন চিন্তা মমিন করেছিলো। কিন্তু অনেক ভেবে চিন্তে ইহা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। আর মমিন একটা বিশেষ গুনের অধিকারী সে কখনো একটা বিষয় নিয়ে বেশি সময় নষ্ট করে না।

 

ডাক্তার জহিরের উপরে অনেক দায়িত্ব। মৃতদের সমস্ত প্রতিবেদন উচ্ছেদকারীদের পক্ষে রাখতে হবে উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশ। প্রতিবেদনগুলো বিনিময়ে তার একটা আবদারও আছে। সে এই শহর ছেড়ে নিজের শহরে ফিরতে চায়। একটা বদলি সুপারিশ দরকার। সপ্তাহে একটা দিনের জন্যও সে যেতে পারে না বাড়িতে। তাকেও কোন পারুলের ঘরে হানা দিতে হতো রাতের অন্ধকারে। জহির খুব ব্যস্ত আজ। কিন্তু মমিন ক্লান্ত হয়ে গেছে। দ্বিতীয় লাশের পরে আর তেমন শক্তি পাচ্ছে না। আজ তাকে জহির কয়েকবার দমকও দিয়েছে। শুয়ে থাকা প্রায় অনেকগুলো লাশকেই জহির খুব ভালো করে চেনে। জহির বহুগমন পুরুষ। কিন্তু লায়লাকে দেখে জহির কিছুটা ভীতস্ত হয়েছে। লায়লার গলায় একটা তিল আছে। হুবুহুব এমনি একটা তিল ছিলো সুমনার গলায়। জহিরের প্রথম প্রেম। তাই সুমনার স্মৃতিচারণ করতে লায়লার কাছে বেশ কয়েকবার যায় জহির। লায়লা অন্যকোন মেকাপ নিতো না। গাঢ় করে কাজল দিতো চোখে। জহিরের আবার মেকাপে অভক্তি রয়েছে। আজও দিয়েছিলো চোখে কাজল। সমস্ত শরীর মৃত হলেও লায়লার চোখ দুটো ছিলো জীবন্ত। ওই চোখ দেখেই জহির ভয় পায়। বেশ ভয় পায়। মমিনের হাত যখন লায়লার শরীর জুড়ে ভ্রমণ করছিলো তখন কয়েকবার মমিনকে দমক দেয় জহির। হঠাৎ হঠাৎ থামতে বলে। মমিন জহিরের চোখের দিকে তাকায়নি একবারও। তাদের কাজের নিয়মে এমনটা নেই। কাজের সময়ে তারা নিজেদের দিকে কখনোই তাকায় না।

রাত বাড়তেই থাকে। ইতোমধ্যে অনেকবার তাদের লাশকাঁটা ঘর থেকে বাইরে যেতে হয়েছে। মিটিং করতে হয়েছে নেতাদের সাথে। আবার ফিরতে হয়েছে কাজে। বাতাসে শঁ শঁ অন্ধকার ভেসে বেড়াচ্ছে হাসপাতালের এলাকা জুড়ে। কোন হ্যালোজিন অথবা এনার্জি লাইটের আলো এই অন্ধকারকে ভেদ করতে পারেনি। জহির, মমিন এবং তাদের সহকর্মীরা নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

তাদের প্রত্যেকেরই দুপুর থেকে প্রস্তুতি ছিলো যে, রাতে অনেকগুলো ময়নাতদন্ত করতে হবে তাদের। হামলা-পালটা হামলা, ইট, হাত বোমা, লাঠির মারামারি। সারাদিন জুড়েই চলছিলো। ঘণ্টা খানেক মারামারি। কিছুক্ষণের জন্য বিরতি। আবার মারামারি শুরু। এমন দফায় দফায় মারামারি চলছিলো সারাদিনজুড়ে। টিভি সাংবাদিকরা ওই দিন তিন-চারবার ফুটেজ পাঠানোর সুযোগ পেয়েছিলো টিভি অফিসে। কারো কারো মাসের বিল বেড়ে গিয়েছিলো দুই-তিনগুন এক ঘটনাতেই। মমিন ঘুম থেকে উঠেছে দুপুর করে। এমন ঘটনা তেমন হয় না। ইদানিং সে দুপুরেই ঘুম থেকে ওঠে। ঘুম থেকে উঠেই স্টার জলসার পর্দায় ‘বেহুলা’ ৬শ তম পর্ব চলছিলো। এই উপলক্ষ্যে তারা একটি বিশেষ পর্ব তৈরি করেছে। সবাই রান্না বন্ধ করে সিরিয়ালটি দেখছে। রাতে দেখতে পারেনি বিদ্যুৎ ছিলো না। তাই দুপুরে পুন:প্রচার দেখছে। বিজ্ঞাপনের সময়ে এক ফাঁকে ২৪ ঘন্টার সংবাদ দেখানো টিভিতে ঘুরতে ঘুরতে যাওয়ার সাথে সাথেই নিজের চেনা পথ ঘাট দেখে ঘুম থেকে উঠে বসে পড়ে মমিন। তখন নিহতের সংখ্যা ২ জন। ঘরের মানুষগুলোর যৌথ প্রতিবাদে রিমোট ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় মমিন। মুখে পানি দিয়ে শার্ট গায়ে জড়াতেই তার সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় লাইজু। লাইজুকে সরিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা মমিনের ছিলো না। এই ঘরে মানুষের মৃত্যুর থেকে বেহুলা সিরিয়ালটির ক্ষমতাই বেশি। কি এক অদ্ভুদ টিভির বাঁধনে বেঁধেছে মন।

 

মোয়াজ্জেম আযান দিতে ঘুম থেকে ওঠার আগেই মমিন ও জহিরের দায়িত্ব শেষ। তারা ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়ি ফিরছে। দুজনের চেহারা দুজনে দেখতে গিয়েই তারা দুজনেই বিপদে পরে যায়। নিজেদের কাছে ধরা পরে যায় নিজেরা। একটা লম্বা গোসল শেষে দুজনের বাসায় ঘুমের দরজায় টোকা মারে। শরীরে নিয়মে তাদের ঘুমিয়ে পড়তে হয়। দীর্ঘ মানসিক খাটুনি এবং শারীরিক খাটুনির পরে তারা আর জেগে থাকতে পারেনি। ঘুমাতে তাদের হয়েছে। মমিনের ঘরে এখন নাক ডাকার সুরে রাত হয়ে উঠছে দিনের আলোয়।

জহির শারমিনকে ফোন করেছে। প্রতিদিনই তাদের নিয়ম করে কথা হয়। এতো সকালে যদিও কথা হয় না। বিয়ের পর তারা বেশির রাতই ফোনে কথা বলে বলে নীশি যাপন করেছে। সকালের দিকে তারা ঘুমায়। কিন্তু আজ জহির একটা সুসংবাদ দিয়ে ঘুমাতে যাবে তাই শারমিনকে ফোন করেছে। তার বদলির সুপারিশ খুব তাড়াতাড়ি হচ্ছে। এই সংবাদে একজনের ঘুম ভেঙেছে আর একজন সংবাদ দিয়েই ঘুমিয়ে পড়লো।

 

সকালের সংবাদ মাধ্যমগুলোতে খবর প্রকাশিত হয়েছে। ধর্মপ্রাণ মানুষ কর্তৃক প্রতিতালয় উচ্ছেদের সময়ে ১৪ জন নিহত, শতাধিক আহত এবং ৫ শতাধিক প্রতিতা শহরের বিভিন্ন জায়গায় পালিয়েছে। কিন্তু মমিনের একটি নিজস্ব সংবাদ মাধ্যম রয়েছে। পাঠক তো জানেই। সেখানে প্রতিদিন শহরের নিহতদের নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেই সংবাদে বানান ভুল হয়। বাক্য গঠনে ভুল হয়। ভাষা শৈলীতে ভুল হয়। কিছু সাহসিক সত্য প্রকাশিত হয়। কিন্তু কেউ পড়তে পারে না সেই সংবাদ। গোপনে গোপনে প্রকাশিত হয় গোপনে গোপনে বিলি হয় মমিনের ঘন কালো চুলের গহীনে। রাতে গাঁজার টানে এবং বাংলা মদের ঘোলাটে জলে ঘোলাটে হয়ে যায় গতকালগুলো। আবার নতুন আলোয় মমিন সকালে বাজার থেকে টাটকা বাজার করে। স্যান্ডির দোকানে চা খায়। চারপাশের লোকজনের কথা-বার্তা শোনে। কিন্তু নিজে কিছুই বলে না।

 

মমিনের আজকের নিজস্ব সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে কতিপয় জমি দালালের পরিকল্পনায় প্রতিতালয় উচ্ছেদ, ১৪ জন নিহত এবং জমি দখল করে একটি বহুতল শপিং মল এবং একটি লিল্লা বোর্ডিং এতিমখানার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন। এই সংবাদ প্রকাশিত হলেও মমিন নিজেও এই সংবাদ পড়তে পারেনি। কারণ আজ সারাদিন মমিন ঘুমিয়ে থাকবে। ঘুম থেকে উঠতে উঠতে মমিনের আরেকটি রাত চলে আসবে। সেই রাতে আরো কিছু লাশ আসবে মমিন তাদের ময়না তদন্ত করার আগে আবার গাঁজার ইস্টিকে দেশলায়ের আগুন দিয়ে জোড়ে জোড়ে টান মারবে। বাংলা মদের ঘোলাটে জলে গতকালগুলো ঘোলাটে করে ফেলবে। মমিনের সামনে শুধুই আগামীকাল থাকবে কোন গতকাল থাকবে না।

মমিনের পাশে যে ডাক্তার থাকবে সে হয়তো জহির নয় মিহির। তারাও কাজের সময়ে দুজনে দুজনের দিকে তাকবে না। কিন্তু পরিবর্তন হলো মিহিরের কোন লায়লা থাকবে না শহরে অথবা তার প্রথম প্রেমিকাকে হারানো দুঃখও থাকবে না অথবা দুটোই থাকতে পারে।

 

পুনশ্চ:

 

কিছুদিনের জন্য এই শহরে কিছু দামি দামি গাড়ির দৌঁড়া-দৌড়ি লক্ষ করা যাচ্ছে। তারা তদন্ত করছে। মমিন যেমন মানুষের শরীর তদন্ত করে হত্যার রহস্য উদ্ধার করে তারা তেমন ঘটনা তদন্ত করে হত্যার রহস্য এবং পেছনের ঘটনা উদ্ধার করে বিবৃতি দেয় টেলিভিশনে। মমিনের তদন্ত করতে গাঁজা-বাংলা মদ লাগে। আরও লাগে একটি ভূতের গল্প-কাহিনি সম্মিলিত ঘর। কিন্তু এদের তদন্তে কি লাগে পাঠক জানার চেষ্টা করলে জানতে পারেন।

বিশেষ এ্যাসাইনমেন্টে এই ঘটনার বিশেষ স্টোরি লিখতে একজন মাঝারি বয়স্ক লোকের সাথে একজন তরুণী এমন কয়েকটি টিম এসেছে শহরে। তারা লেকের পাড়ে চা খেয়েছে। হোটেল রুমে ফ্যানের বাতাস খেয়েছে। হাফ রিম প্রতিবেদন লিখেছে।

 

লিল্লা বোর্ডিং এতিমখানা মাদ্রাসার কাজ দ্রুত অগ্রগতি হচ্ছে। কয়েকবার এখানে মিটিং হয়েছে। এই তহবিলের জন্য টাকা সংগ্রহ চলছে।

বিদেশি কিছু গণমাধ্যম এবং মানবাধিকার সংস্থা পরপর কয়েকবার বিবৃতি দিয়েছে। যতদিন ইস্যুটি গরম গরম ছিলো ততদিন স্ব-উদ্যোগে অনেকে অনেক কিছুই বলেছে। আরও কিছু আন্তর্জাতিক ঘটনার ভিড়ে হুট করে ঘটনাটি হারিয়ে গেছে।

এরিই মধ্যে বহুতলা শপিংমলের তিনতলার কাজ সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। বড় বড় সাইনবোর্ড লাগানো হয়েছে সেখানে রঙিন অক্ষরে লিখেছে ব্যাংক, বীমা অফিস ভাড়া দেওয়া হবে।

 

এতিমখানা মার্দাসার মিটিং চলছে-ই। কিছুদিন পর পরই মিটিং ডাকা হয়। তহবিল সংগ্রহের জন্য কমিটি করা হয়। কিন্তু কোন ইটের দেখা পায় না এতিম খানাটি।

 

হঠাৎ করেই একদিন মমিনকে বহুতলা শপিং মলের সামনের লম্বা সিঁড়িতে বসে থাকতে দেখা গেছে। তিনি বসে বসে মনযোগ দিয়ে একটি মেয়ের সাথে একজন কলেজ পড়ুয়া ছেলের ঘনিষ্ট অবস্থায় গল্প-গুজুবরত দেখছেন এবং মুচকি মুচকি হাসছেন। মেয়েটি-ছেলেটি কিছুক্ষণ গল্প-স্বল্প করেই শপিং মল ছেড়ে বাইরে বের হয়ে এসেছে। মমিনও বেড়িয়েছে তাদের পিছন পিছন। তারা রিক্সায় উঠছে তাদের অনুসরণ করে মমিনও রিক্সায় উঠছে। রিক্সা গলির ভিতর দিয়ে ছুটছে ছুটতে একটি বিল্ডিং এর সামনে দাঁড়িয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে ছেলে-মেয়ে দুজনই উপরে চলে গিয়ে একটি ফ্লাটে ঢুকলো। মমিন অঙ্ক কষে কষে রসহ্য উদ্ধার করেছে এই ফ্লাটে শুধু ওই মেয়েটি নয় আরো অনেক মেয়ে থাকে। যেই মেয়েটির পিছন পিছন মমিন এসেছে সেই মেয়েটির নাম শায়লা। পারুলের সাথে একই ঘরে থাকতো শায়লা। মিষ্টি করে কথা বলতো। মমিনকে দাদা দাদা বলে ডাকতো।

 

জহির কোন এক রাতে তার নিজের বউয়ের সাথে; না তার বউ না; তার স্ত্রীর সাথে (জহিরের আবার বউ শব্দটা খুব পাতলা ধরনের শব্দ বলে মনে করে তাই তিনি বউ কে স্ত্রী বলতে বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন) গভীর রাতে সহবাসে ব্যস্ত। সহবাসের এক পর্যায় সে নিরীক্ষা করতে থাকে হিপোক্যাম্পাস বিষয়টি কি সত্যিই কাজ করে। তার কি বুদ্ধি ও সৃজনশীল দক্ষতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জহির বেশিক্ষণ চিন্তা করার সুযোগ পায় না তার স্ত্রীর দমকে সে মনযোগ দেয় তাদের নিবিড় চাষে। আজ তারা ফসলের জন্য বীজ বুনবে।

×